কাকতালীয়

রবিবার, মৌনমুখরের বন্ধের দিন আর আমার ছুটির। সদ্য পাওয়া ক্যাননের 1DX Mark ii ক্যামেরাটা নিয়ে রেওয়াজে যাওয়ার উত্তম দিন, নতুন ব্যাট হাতে পেলে ব্যাটটার জন্য আলাদা ভাবে প্র্যাকটিসে যাওয়া যেমন হয় আর কি। এদিক ওদিক করে, এরম সেরম করে দেখে নেওয়া যায় compatibility, controls, outputs ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে আমি ঠিকানা বেছেছিলাম কাকদ্বীপ ব্লকের অন্তর্গত হারউড পয়েন্ট কোস্টাল এলাকায় ৪ নম্বর জেটিঘাট সংলগ্ন বসতি। সকাল বেলার সময়, নদীবাঁধকেন্দ্রিক জীবনযাপন, জনসমাগম খুবই নগণ্য। আপন খেয়ালে ক্যামেরাটা নিয়ে কিছুটা সময় নাড়াচাড়া করতে করতে আমার চোখ পড়লো দুই বন্ধুর উপর, তাদের আনুমানিক বয়স ১০-১১ বছর হবে। তারা গল্প করছে বাঁধে বসে জিগরি দোস্তের মতো। তাদের সাথেও একটি যন্ত্র রয়েছে, মাছ বা কাঁকড়া ধরার একটি ঘরোয়া যন্ত্র, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় ছেগিন জাল বলে থাকে। কোথাও কোথাও চাক জালও বলা হয়।

ওদের অচেতনে কিছুটা দুর থেকেই ওদের একটি ছবি তুলতেই শাটারের শব্দে ওরা চকিত হলো, স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই এগিয়ে এসে ভাব জুড়লো আমার সাথে। ব্যাস,  আমিও চাঁদ পেলাম হাতে, বসে পড়লাম দিব্যি ঘাসের উপর ওদের গা ঘেঁষে।
সুজয় এবং রাহুল। আমার ক্যামেরা টেস্টিং জলে গেলো, আমি চলে গেলাম ওদের দেশে। ওরা দুজনেই একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে, ক্লাস ফাইভে। স্কুলটা বাড়ি থেকে মোটামুটি দূরেই, খুব একটা কাছে নয়। একসাথেই যাওয়া আসা করে। সারা সপ্তাহ স্কুল টিউশন বইপত্তর নিয়েই কাটে, এবং একটু আধটু মাঠঘাটের খেলাধূলা। এবং এই রবিবার আসলেই ওরা লাগামছাড়া, দুজনে মিলে কাঁকড়া ধরার ওই ঘরোয়া যন্ত্রটি নিয়ে চলে আসে এই নদীর পাড়ে। শান্ত নিরিবিলি সবুজে ঘেরা পাখির কূজনে বিহ্বলিত এই মুড়িগঙ্গার তীরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টার বসে থাকে। টুকটাক ফিসফিসিয়ে গল্প করে আর জোয়ারের জল কূল ছাপিয়ে বাঁধের কাছাকাছি এলে সেই জলে ওরা কাঁকড়া ধরে। আহারে জীবন! এটা ওদের প্রতি রবিবারের রুটিন বলা চলে। ওদের স্কুলের পড়াশুনায় আলাদা করে ফেভারিট কোনো সাব্জেক্ট নেই। সব বই ওদের পড়তে ভালো লাগে, অংক করতে তো আরোই ভালো লাগে। ইংরেজীটা একটু খটমট লাগে বটে, অন্যের ভাষা তো।

ওদের বাবারাও একে অপরের বন্ধু, এক সাথে কাজ করে, মাছ ধরে। একজনের বাবার তো একটা মাছ ধরতে যাওয়ায় ট্রলারও আছে, খুব বড়ো নয় তবে ভালোই, একেবারে যে ডিঙি নৌকো তাও নয়, আমি দেখেছি সামনেই নদীর কূলে রাখা ছিলো, রিপেয়ারিংএর কাজ চলছিলো। ওদের বাবারা মাঝে মাঝে কারুর একটা বাড়িতে বসে মদও খায়, ওরা দেখেছে, ওরা জানে মদ খাওয়া কি জিনিস, তবে সেসব নিয়ে যে বাড়িতে ঝামেলা হয় তা কিন্তু নয়। আমি দেখেছি সেসব বাড়ির বাচ্চারা এদের মতো হতে পারে না। আমি ভেতরে ভেতরে অবাক হচ্ছিলাম ওদের একাগ্রতা নিয়ে, স্থিরতা নিয়ে। ওরা যেভাবে কাঁকড়া ধরতে এসেছে, বড়শী বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরার মতই একাগ্রতা এবং স্তিরতাই সেখানে মূল মূলধন। 


যে বয়সে ছাড়া পেলেই কৈলে বাছুরের মতই দৌড়ে বেড়ানোর কথা সেই বয়সে রুটিন মাফিক সপ্তাহে একটা দিন ওরা নদীর বাঁধে নিরিবিলিতে বসে রয়েছে জোয়ারের জল বাঁধের পায়ে ঠেকার অপেক্ষায়। জল বাড়লেই ওরা সুড়সুড় করে নেমে যাবে নিচের দিকে ছেগিন জাল দিয়ে কাঁকড়া ধরতে। তার আগে ওরা আধা ঘন্টা এক ঘন্টা ঠায় বসে থাকবে বাঁধের উপর আর থেকে থেকে ফিসফিসিয়ে গল্প করে নেবে দুই বন্ধু মিলে। কি বিষয়ে গল্প করে ওরা?

ওদের সাথে কথা বলে বলা ভালো গল্প করে আমার মনে হয়েছে ওরা অবচেতনে সচেতন। বয়স বাড়লে, ওই নদীর বাঁধ থেকে ওরা বড় রাস্তার সমাজে উঠলে কি হবে জানিনা। কিন্তু এই এখন এই সময়ে এই মুহূর্তে ওদের দৃঢ়তা ওদের ঐক্য ওদের বন্ধুত্বের নিখাদ ঘনত্ব ওদের স্থিরতা আমায় মুগ্ধ করেছে। কথা দিয়েছি ওদের দুজনের ছবি প্রিন্ট কপি ওদের দেবো পরের রবিবার গিয়ে। ওদের থেকে যা পেয়েছি তা লিখতে পারার সাহিত্যবোধ আমার নেই, পরিবর্তে ওটুকুই দিতে পারি ওদের।  এ নিয়েই জীবনের ছবি তুলি বলা ভালো ছবি সাজাই।

Comments

  1. বেশ ভালো, যেন এভাবেই ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে কোনো এক জায়গা কে বেশ ভালোভাবে চেনা যাই.. সবচেয়ে ভালো লাগলো প্রিন্ট টা দেবে ওদের তাই, এভাবেই তো ছবির এই উপহার ভাগ করে নিতে হয়...

    ReplyDelete
  2. খুবই ভালো! সহজ সরল ভাষা! ❤ আমিও YouTube এ ঠিক এই গুলোই শেয়ার করি ভিডিও ও conversation আর voice-over দিয়ে!
    ভালো লাগলো বেশ!

    ReplyDelete
    Replies
    1. Channel tar নাম বললে ভালো হতো একটু ঘুরে আসা যেত...

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আলাপ

50 MM এবং